সুপারফুড স্পিরুলিনা এর স্বাস্থ্য উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম স্পিরুলিনার উপকারিতাঃ \"স্পিরুলিনা\" এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ যা সায়ানোব্যাক্টেরিয়া নামে পরিচিত। দেখতে লতা পাতার মতো হলেও এর রয়েছে চমৎকার স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য উপকারিতা যা নিঃসন্দেহে আপনি আগে জানতেন না। দেখুন তাহলে এর অবাক করা উপকারীতার কিছু দিক! ভিটামিন ও মিনারেল স্পিরুলিনাতে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি১ (থায়ামিন), বি২ (রিবোফ্ল্যাভিন, বি৩ (নিকোটিনামাইড), বি৬ (পাইরিডক্সিন), বি৯ (ফলিক এসিড), ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন ই রয়েছে ।স্পিরুলিনা পটাশিয়ামের এক আদর্শ উৎস । এছাড়াও এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ক্রোমিয়াম, কপার, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, মাঙ্গানিজ, ফসফরাস, সিলেনিয়াম, সোডিয়াম এবং জিংক । ১. হজমশক্তি বৃদ্ধি করেঃ ই.কোলাই এবং চান্দিদার মত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি দমন করে । স্পিরুলিনা পাচনতন্ত্রএর মধ্যে ল্যাক্টোবেসিলাস এবং বিফিডোব্যক্টেরিয়ার মত ভাল ব্যাকটেরিয়া তৈরী করে। সুতরাং, এটা পুষ্টি শোষণ করে শরীরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে হজম শক্তি বাড়ায়। ২. এলার্জির জমঃ প্রায় ৬ মাস ধরে দৈনিক স্পিরুলিনা গ্রহণ এলার্জি উপসর্গ কমিয়ে দেয়। ধুলোর অতি ক্ষুদ্র পরজীবী কীটবিশেষ, ছাঁচ, এবং পোষা প্রাণী, ফুলের পরাগ বা বহুবর্ষজীবী এলার্জি থেকে এলার্জিক রাইনাইটিস থেকে রক্ষা পেতে স্পিরুলিনা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করা যেতে পারে। ৩. যকৃতের জন্য অত্যন্ত ভালঃ স্পিরুলিনা যকৃতের ক্ষতি, যকৃতে ব্যথা এবং সিরোসিস এর বিরুদ্ধে কাজ করে শরীরকে রক্ষা করে। এটা ভিটামিন বি, ই, ম্যাঙ্গানিজ দস্তা, লোহা, তামা, সেলেনিয়াম, এবং প্রোটিনের মত খনিজ সমৃদ্ধ উৎস। এছাড়া এটা যকৃতের ব্যথা হ্রাস করে এবং যকৃতে ট্রাইগ্লিসেরাইড এর ক্ষতি এড়িয়ে যেতে সক্ষম। ৪. চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করেঃ স্পিরুলিনা যে কোন ধরণের ক্ষতি থেকে চোখকে রক্ষা করে। যা ম্যাঙ্গানিজের উত্তম উৎস উচ্চ পরিমাণে দশ গুণ বেশি ভিটামিন রয়েছে। এটি ছানির পতন এবং মাচুলার মত চক্ষু রোগ ভাল করে শক্তিশালী এবং পুষ্টিকর করে তোলে। ৫. ডায়াবেটিস প্রতিরোধঃ স্পিরুলিনা ইনসুলিন উৎপাদনকারী অংশ প্যানক্রিয়াসের নিস্কিয় কোষগুলোকে (B-Cell) ধীরে ধীরে পুনঃজীবিত করে তোলে । তাই ইনসুলিন হরমোন নিঃসরনে সাহায্য করার কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে । স্পিরুলিনার মধ্যে প্রচুর ফাইবার, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের উপস্থিতি ডায়াবেটিস কমায়। এটি ডায়াবেটিকসের মধ্যে লিপিড মাত্রা উন্নত করতে সাহায্য করে।এতে linolenic অ্যাসিড রয়েছে। ৬ মাস দৈনিক দুইবার স্পিরুলিনা গ্রহণের রক্তে শর্করার মাত্রা সুষম থাকে। ৬. কিডনিকে বিষাক্ততা থেকে বাঁচায়ঃ স্পিরুলিনা ক্লোরোফিল একটি উচ্চ ঘনত্ব সম্পন্ন এবং সেরা প্রাকৃতিক Detoxifiers। এটা কিডনি থেকে ভারী ধাতু, ক্ষতিকারক রশ্মি, এবং দূষণকারী মুছে কিডনি বিষাক্ততা কমায়। ৭. রোগ প্রতিরোধকারী ইমিউন সিস্টেম উন্নত করেঃ স্পিরুলিনার মধ্যে পলিস্যাকারাইড উপস্থিতি যার ফলে রোগ এর বিভিন্ন বাধা, ইমিউন সিস্টেম উন্নত করার জন্য সুনাম রয়েছে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া শরীর থেকে ক্ষতিকারক টক্সিন বের করতে সাহায্য করে যারা খুব বেশি দুর্বলতা অনুভব করে থাকেন তারা সতেজ থাকার জন্য স্পিরুলিনা সেবন করতে পারেন। যারা মনে রাখতে পারেন না, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি তাদের জন্য এটা খুব উপকারী। ৮. ওজন কমাতে সাহায্য করেঃ স্পিরুলিনাতে ৬০-৭০% প্রোটিন আছে যা ক্ষুধা কমায় এবং আপনার শরীরের স্তূপাকার চর্বিকে নিরাময় করে। আপনি যদি দ্রুত ওজন কমাতে চান তাহলে স্পিরুলিনা হতে পারে ভালো প্রতিকার। ২৫০ মিলি পানির সাথে দুইটি ক্যাপসুল খুলে স্পিরুলিনা পাউডার এবং এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে খেতে পারেন ৯. তাৎক্ষনিক শক্তি সহায়তাকারীঃ স্পিরুলিনা বিপাক বৃদ্ধি এবং তাত্ক্ষণিক শক্তি প্রদান করে। ক্লোরোফিল এবং Phycocyanin সমৃদ্ধ, এটা আপনার শক্তির মাত্রা অনুমোদন শর্করা তৈরি করতে সূর্যালোক থেকে শক্তি শোষণ করে, এটা মনোবল তৈরী করে। ১০. রক্তাল্পতা কমায়ঃ স্পিরুলিনাতে প্রচুর ক্লোরোফিল রয়েছে। যা রক্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিমোগ্লোবিনে রূপান্তরিত হতে পারে এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তাছাড়া স্পিরুলিনাতে ভিটামিন বি, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন ও অ্যামিনো এসিড রয়েছে যা রক্ত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে প্রচুর ক্লোরোফিল ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা রক্তের দূষক পদার্থসমূহ দূর করে এবং রক্ত পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। আয়রনের অভাব বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে খুবই সাধারণ ও তা ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। স্পিরুলিনা আয়রনের সেরা প্রাকৃতিক সূত্র। ১১. ক্ষত নিরাময়ঃ স্পিরুলিনা ব্যাকটেরিয়া, খামির এবং ছত্রাক বৃদ্ধি Inhibiting দ্বারা ক্ষত নিরাময়ে দ্রুততর একটি নিখুঁত প্রাকৃতিক প্রতিকার যা বিরোধী জৈব এবং বিরোধী প্রদাহজনক বৈশিষ্ট্য আছে। ১২. শিশুদের জন্যঃ শিশু বিশেষজ্ঞরা বাচ্চাদের সবসময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয়ে উঠে না আবার বাচ্চারা খেতেও চায় না। পুষ্টি সমস্যা পূরণে স্পিরুলিনা ভালো ভূমিকা রাখে। ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট বা মেধা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাচ্চাদের দুধ ভাতের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। ১৩. মেনোপজ উপসর্গের হ্রাসঃ কয়েক মাসের জন্য দৈনিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্পিরুলিনা গ্রহণ দুঃসহ স্মৃতিচারণায়, বিষন্নতা ও উদ্বেগ এর মত মেনোপজ উপসর্গ কমিয়ে দেয়। এবং মেনোপজ চলছে এমন নারী স্পিরুলিনা নেওয়ার পর মানসিক প্রশান্তি এবং মানসিক ভারসাম্য অভিজ্ঞতা হবে নিশ্চিত। ১৪. স্তন ক্যান্সার থেকে রক্ষা করেঃ স্পিরুলিনা ক্যান্সার হওয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করে। স্পিরুলিনার নীল-সবুজ রঙ এটা ক্যান্সা্রের কোষ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। স্পিরুলিনা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নামক সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে স্পিরুলিনা স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা কার্যকর প্রমাণিত দেখানো হয়েছে। ১৫. বাত প্রতিরোধ করেঃ স্পিরুলিনা প্রকৃতি বিরোধী প্রদাহ এবং বাত রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর অতিরিক্ত পুষ্টি পেতে সস, পাস্তা, সালাদ, রুটি আকারে আপনার খাদ্যের মধ্যে স্পিরুলিনা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। ১৬. অ্যাল্জায়মার প্রতিরোধঃ অ্যাল্জায়মার রোগ এর কারণে প্লেক মেমরি ক্ষতি ঘটাচ্ছে, যা Amyloid-Beta প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে থাকে। স্পিরুলিনা সেবনে এই প্রোটিন মাত্রা হ্রাস করা যায় এবং আল্জ্হেইমের রক্ষা করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, আক্রমণের ফলে তার পক্বতা প্রতিরোধ মৌল থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করে। ১৭. মেজাজ ফুরফুরে রাখেঃ স্পিরুলিনা অ্যামিনো অ্যাসিড এল-ট্রিপটোফেন, আপনার মেজাজ ভাল করে এবং হাসিখুশী রাখে। ১৮। মুখের দুর্গন্ধ দূর করেঃ স্পিরুলিনার মধ্যে ক্লোরোফিল কন্টেন্ট থাকে, এটা মুখের দুর্গন্ধ দূর করে । সেজন্য বাজারে পাওয়া অধিকাংশ বাণিজ্যিক মুখ ফ্রেশনার এর প্রধান উপাদান এই স্পিরুলিনা । ১৯। নখ সুস্থ রাখেঃ স্পিরুলিনা হচ্ছে ক্লোরোফিল, আয়রন, ভিটামিন এবং বি১২ সমৃদ্ধ, সুস্থ নখ এর জন্য একটি বিস্ময়কর খাদ্য গড়ে তোলে । স্পিরুলিনা সেবনে নখ সকসময় ভাল থাকবে । ২০। যৌন শক্তি বাড়ায়ঃ এটা প্রশস্ত প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টিকারক পদার্থ এবং এনজাইম এর সাথে যোগ করা হয় । স্পিরুলিনা উল্লেখযোগ্য ফলাফল অর্জন করে যৌন শক্তি বাড়িয়ে দেয় । ২১। দাতেঁর স্বাস্থ্য ভাল করেঃ স্পিরুলিনা সুস্থ দাঁত বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে । এতে প্রচুর ফসফরাস এবং ক্যালসিয়াম রয়েছে । সবুজ নীল শেওলাগুলি আপনার মাড়ির জন্য অত্যন্ত উপকারী । ২৩। ডার্ক সার্কেল হ্রাসঃ স্পিরুলিনা Detoxifying উপাদান চোখের চারপাশে কালোদাগ মুছে ডার্ক সার্কেল কমাতে সাহায্য করে । এটা আপনার চোখ উজ্জ্বল এবং সতেজ লুক দেয় । ২৪। সুন্দর ত্বকঃ স্পিরুলিনায় ভিটামিন সি, ই, কে এবং ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, থেকে বি৬, বি৯, দস্তা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, আয়রন, পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম আছে যা ত্বকের জন্য বিস্ময়কর উপাদান । এসব পুষ্টি দীপ্তিময় ত্বকের জন্য অপরিহার্য । এর ক্লোরোফিল ত্বকের মূলে ঢুকে আপনার ত্বককে নরম করে তোলে । ২৫। মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ স্পিরুলিনা Folate এবং ভিটামিন বি সমৃদ্ধ উৎস হওয়ায় এটি মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা উন্নতিতে একটি অনেক বড় ভূমিকা পালন করে । স্পিরুলিনা শরীর থেকে ভারী উপাদান এবং বিষক্রিয়াগত মাথাব্যথা দূর করে । ২৬। এন্টি খুশকিঃ স্পিরুলিনা মাথার স্তরপূর্ণ চামড়া বা খুশকি সরিয়ে ফেলে । এছাড়া, স্পিরুলিনার মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমূহের ঐশ্বর্য কার্যকরভাবে খুশকি মুক্ত করে । মাত্র ৪ সপ্তাহে খুশকি থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য নিতে পারেন স্পিরুলিনার । ২৭। প্রতিরোধ করে হেয়ারফলঃ চুলের ক্ষতি মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশী কষ্টকর । অনেকেই আছেন যারা চুল পড়া নিয়ে অনেক চিন্তিত । স্পিরুলিনা আপনার মূল্যবান চুলের অধিক পড়া রোধ করে । গুঁড়া, ট্যাবলেট বা রস হিসাবে স্পিরুলিনা গ্রহণে চুলে আরও সুন্দর হবে । ২৮। এন্টি ব্রণঃ স্পিরুলিনা ব্যাকটেরিয়া বিরোধী । এটি দ্রুত মৃত কোষটিকে অপসারণ করে এবং উন্নত নতুন কোষ উৎপাদন করে । এটা ত্বকে Candida ব্যকটেরিয়ার অতিবৃ্দ্ধি প্রতিরোধ করে ব্রণ Breakouts থেকে আপনার ত্বক রক্ষা করে । ২৯। নিরামিষ ভোজীদের জন্যঃ এতে বেশি পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন বি১২ রয়েছে যা নিরামিষ ভোজীদের এ দুটি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি কমায়। কারণ তাদের খাদ্য তালিকায় প্রোটিন ও ভিটামিন বি১২ অনুপস্থিত থাকে। ৩০। উচ্চ রক্তচাপেঃ উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ৬ মাস টানা স্পিরুলিনা সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে। স্পিরুলিনা যেভাবে খেতে পারেনঃ ১৫ বছরের নিচে প্রতিদিন ১ টি ক্যাপসুল। ১৫-২৫ বছর প্রতিদিন সকালে ১টি রাতে ১ টি ক্যাপসুল। ২৫-৩৫ বছর প্রতিদিন সকালে ২ টি রাতে ১ টি ক্যাপসুল। ৩৫+ প্রতিদিন সকালে ২ টি রাতে ২টি ক্যাপসুল। বিঃদ্রঃ রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএফএম জামাল উদ্দিন বলেন এটা কোন মেডিসিন না। এটা একটা সাপ্লিমেন্টারী ফুড। এটার কোন স্বাদ নেই। যেকোন খাবারের সঙ্গে এটি খাওয়া যায়। আপনি যেকোনো ভাবে এটা খেতে পারেন। জুস্ করে খেতে পারেন, চায়ের সাথে মিশিয়ে, যেকোনো ভর্তা/তরকারি শাক সবজি বা সালাদের সাথে সামান্য পরিমাণ মিশিয়ে খেতে পারেন। এছাড়া রুটি, আলুভর্তা, নুডলস্, শরবত, হালুয়া ইত্যাদিতে স্পিরুলিনা মিশিয়ে নানা খাবার তৈরি করে খেতে পারেন।